top of page
Writer's pictureNiaz Murshed Chowdhury

নেতিবাচক চিন্তার জননী হচ্ছে ভয়। ভয় এক অদৃশ্য ভূত।

আমরা পরাজিত হতে চাই না। এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি সচেতনভাবে পরাজিত হতে চান। সবাই আশা করেন যে তিনি জয়ী হবেন, জীবনে বড় হবেন, অসাধারণ কিছু করবেন। এই সাফল্যের পথে, আলোকিত পথে যে সব বাধা/ প্রতিবন্ধকতা থাকে তার মধ্যে ভয় অন্যতম। আমরা এগুতে চাই কিন্তু দেখা যায় আমাদের পায়ে বাঁধা ভয়ের শিকল আমাদেরকে সামনে এগুতে দেয় না। আমরা পা তুলি কিন্তু সাফল্যের সিঁড়িতে আমাদের পা ফেলতে পারি না কারণ ভয়ের শিকল আমাদেরকে পেছনের দিকে টানে, আমাদের সাহসকে কুরে কুরে খায়। এ কারণেই প্রবাদ আছে, বনের বাঘে খায় না মনের বাঘে খায়। কোয়ান্টাম মেথড কোর্সের প্রথম দিন মনের যে-সব আত্মবিনাশী প্রোগ্রাম নিয়ে শ্রদ্ধেয় গুরুজী আলোচনা করেন তার মধ্যে ভয় অন্যতম। আর কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের অষ্টম অধ্যায়েও এ নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে।

নেতিবাচক চিন্তার জননী হচ্ছে ভয়। ভয় এক অদৃশ্য ভূত। অনেকের জীবনেই ভয় তাড়া করে বেড়ায় ছায়ার মতো। ভয় যে কত ধরনের হতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। অবশ্য ভয়কে বিশ্লেষণ করলে আমরা প্রধানত দু’ধরনের ভয় পাই। একটার প্রভাব ইতিবাচক। অন্যটির প্রভাব নেতিবাচক। ইতিবাচক ভয় অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে পরিণত হয়েছে। তা যুক্তিসঙ্গত ও সার্বজনীন। যেমন আগুন লাগার ভয়। যদি আগুনের ব্যাপারে আপনার কোনো ভয় না থাকে তবে আপনি এমন বেপরোয়া হয়ে যাবেন যে আপনি সম্ভবত আগুন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আপনার যদি রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে কোনো ভয় না থাকে তাহলে দুর্ঘটনা ঘটবে। আগুন ও দুর্ঘটনার ভয় আপনাকে/ আমাকে সতর্ক ও সজাগ রাখে, আপনার/ আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অজ্ঞানতার ভয়। এ ভয়ই স্কুল ও শিক্ষায়তনের জন্ম দিয়েছে। পচা-বাসি খাবারের ভয়ই পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতার জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের যুক্তিসঙ্গত, ইতিবাচক ও কল্যাণকর ভয়ের আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এই ভয়গুলোই সৃজনশীল শক্তিতে পরিণত হয়।

আমাদের এখানকার মূল আলোচনা হচ্ছে নেতিবাচক ভয় নিয়ে যা আমাদেরকে কুরে কুরে খায়। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার তার ‘ভাঙো দুর্দশার চক্র’ বইটিতে বলেছেন, ‘… অল্প ভয় আনন্দের কিন্তু বেশি ভয় ভয়াবহ। আমার ধারণা, যা-কিছু মানুষকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, ভয় তার একটা। আমরা যাদের রিপু বলি যেমন : কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য-এরা সবাই মাঝেমধ্যে আমাদের ক্ষতি করে। কিন্তু ভয় আমাদের ক্ষতি করে প্রতিদিন। সীমা অতিক্রম করে গেলে ভয় সত্যি ভয়ংকর’।



ভয়ের রকম :

এবার প্রজ্ঞা জালালি কার্যক্রমে কে কী ভয় পান সেটা লিখে জমা দিতে বলা হয়েছিল। সেখান থেকে পয়েন্ট সাজিয়ে ২৭৬ ধরনের ভয় শনাক্ত করা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে থেকে প্রধান কয়েকটি ভয়,


যেমন :
১. রোগ ভয়। সুস্থ তো আছি কিন্তু কখন না জানি অসুস্থ হয়ে পড়ি।
২. লোকভয় বা লোকলজ্জা। কোনো কাজ করতে চাই কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে করতে পারি না। ইচ্ছা থাকলেও ভালো কাজ করা হয়ে ওঠে না।
৩. বার্ধক্যের ভয়। এখন তো তরুণ আছি, কিন্তু বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।
৪. প্রিয়জন বিচ্ছেদের ভয়। কাছের মানুষ যদি দূরে সরে যায় বা ছেড়ে চলে যায়।
৫. নিরাপত্তার ভয়। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, খারাপ কিছু ঘটে। ভালো আছি কিন্তু এই ভালো থাকার সময় যদি আর না থাকে।
৬. ব্যর্থতার ভয়। সাফল্য যদি না আসে। কাজ করতে গিয়ে যদি ব্যর্থ হয়ে যাই, যদি ব্যর্থতার জন্যে অপমানিত হতে হয়।
৭. দারিদ্রের ভয়। কখন না জানি গরিব হয়ে যাই, আর্থিক টানাটানিতে পড়ে যাই।
৮. পোকামাকড়ের ভয়, ক্ষতিকর জীবজন্তুর ভয়।
৯. ভূতের ভয়, অলীক/ কাল্পনিক কোনো কিছুর ভয়।
১০.মৃত্যুভয়।

ভয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে মৃত্যুভয়। আমরা সবসময় আতঙ্কিত থাকি যদি মারা যাই! ভাবখানা এমন যে আমার আগে কেউ মারা যায় নি। আমিই প্রথম মারা যাব। অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে পৃথিবীতে আসার পর জীবনে যদি একটি মাত্র সত্য থাকে তবে তা হচ্ছে মৃত্যু। আপনি যত ভালো কাজ করেন না কেন আপনি মারা যাবেন। যেমন নবী-রসুল, দরবেশ, মুনি-ঋষি, ধর্মবেত্তা সবারই দৈহিক মৃত্যু হয়েছে। আবার সবচেয়ে খারাপ কাজ যারা করেছে, জুলুম করেছে, অত্যাচার করেছে, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেছে, তারাও মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পায় নি। লৌহ যবনিকার মাঝেই স্টালিন মারা গেছেন। সিআইএ-এফবিআই কেনেডিকে বাঁচাতে পারে নি। হিটলার বোমাপ্রুফ বাঙ্কারে আত্মহত্যা করে ভবলীলা সাঙ্গ করেছেন। মৃত্যু জীবনের অবধারিত সত্য। তাই মৃত্যুকে ভয় পাওয়া বোকামি মাত্র। অর্থাৎ বাঘের হাতে মুত্যু আসুক বা বিছানায়, মারা আপনি যাবেনই। মৃত্যু জীবনের অবধারিত সত্য। তবে যদি আপনি মৃত্যুকে ভয় পান তবে প্রতিদিন আপনি নব নবভাবে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করবেন। আর মৃত্যুকে ভয় না পেলে আপনি শুধু একবারই মারা যাবেন। সেজন্যেই বলা হয়, ভীরু মরে হাজার বার আর বীরের মৃত্যু একবার।


আসলে ভয় বনাম সাহস : পার্থক্যটা নেতিবাচক আর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির


প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভয়গুলোকে আমরা ইতিবাচক বা নেতিবাচক-উভয় দিক থেকেই দেখতে পারি। রোগ হলে কী হবে এই ভয় না করে আমরা কীভাবে সুস্থ থাকতে পারি সেটা নিয়ে কাজ করতে পারি। বার্ধক্য নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে তারুণ্যকে ভালো কাজে লাগাতে পারি। প্রিয়জন বিচ্ছেদের ভয় না করে তাদের সাথে কাটানো সময়কে শ্রেষ্ঠ সময়ে রূপান্তর করতে পারি। দুর্ঘটনা ঘটলে কী হবে সে দুশ্চিন্তা না করে কীভাবে নিরাপদে থাকা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে পারি। অর্থাৎ, ভয়ের কারণ হতে পারে বাস্তব অথবা কাল্পনিক, কিন্তু এই ভয়ের অনুভূতির সাথে আমরা কী আচরণ করছি সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই ব্যর্থতাকে ভয় পান। কাজ শুরু করতে পারেন না। পাছে লোকে কিছু বলে। হয়তো কাজ শুরু করতে চেয়েছেন কিন্তু পারেন নি। কাজ শুরু করতে গিয়ে বিদ্রুপ শুনেছেন। আপনি সফল হবেন না বলে বিশ্বাস করলে আপনি কাজ শুরু করতে পারবেন না। আর কাজ শুরু না করা এক গুরুতর অপরাধ। মনকে বলুন, সাফল্যের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, ব্যর্থতা অতিক্রমের মাধ্যমেই আসে সাফল্য। কাজ শুরু করুন। লক্ষ্য উঁচু রাখুন। কথায় বলে, সূর্যের দিকে তীর মারলে তা অন্তত বড় গাছের মগডালে গিয়ে লাগবে। তাছাড়া ব্যর্থতার চিন্তাকেও আপনি ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারেন। যেমন একটি উদ্যোগে যদি আশাব্যঞ্জক ফল না পাওয়া যায় তাহলে এর বিকল্প কী পদক্ষেপ নেয়া যায় আগে থেকেই তা ঠিক করে রাখুন। তখন ভয় আপনার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। কীভাবে ভয়কে জয় করা যায়?

(১) ভয়কে খুঁজে বের করে লিখে ফেলা : ভয়ের জন্ম হচ্ছে আমাদের অবচেতন মনে। মন যদি সমুদ্র হয় তাহলে ভয় হচ্ছে এই সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে থাকা সব প্রাণী। আমরা যদি আমাদের অবচেতন মনের সমুদ্রে এই ভয়গুলোকে বিচরণ করতে দেই তাহলে আমাদের অজান্তেই এগুলো লালিতপালিত হয়ে নাদুস-নুদুস হয়ে উঠবে। এগুলোর হাত থেকে আমরা কখনো রেহাই পাব না। এগুলোকে যদি কোনোভাবে সমুদ্রের তীরে নিয়ে আসা যায়, তাহলেই এগুলোর মৃত্যু ঘটে। ভয়কেও এই একইভাবে মোকাবেলা করতে হবে। এজন্যে ভয়গুলোকে কাগজ-কলমে লিপিবদ্ধ করে ফেললে, এগুলোকে যথাযথভাবে শনাক্ত করা যায়, এগুলোর উৎস খুঁজে বের করা যায়। একবার এগুলোকে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করতে পারলে এগুলোর আকৃতি হবে লিখিত অক্ষরের সমান। তখন আপনি এ ভয়গুলোর বিরুদ্ধে সহজে পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।

ভয় কখনো গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের আলো সহ্য করতে পারে না। ভয় হচ্ছে অন্ধকারের কীট। আলোয় এলেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। আমাদের জীবনের সবচেয়ে বেশি সমস্যার কারণ হচ্ছে অনির্দিষ্ট ভয়। ‘যদি এমন হয় তবে কী হবে’ এই আতঙ্কই আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। তাই আপনার আশঙ্কাকে কাগজে-কলমে স্পষ্ট করে লিখে ফেলুন। লেখার পর জিজ্ঞেস করুন, এরপর কী হবে? সবচেয়ে খারাপটাই লিখুন। কাগজে বড় করে লিখুন। যাতে করে আপনি দেখতে পারেন। ভয়ের হাত থেকে বাঁচার সহজ পথ একটাই। তা হচ্ছে ভয়ের কথা কাগজে লিখে তা পুড়িয়ে ফেলা। এভাবে আপনি পর্বত প্রমাণ ভয়কেও নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারেন। কারণ যখনই অজানা জানা হয়ে যায়, তখনই ভয় তার রহস্য ও শক্তি দুই-ই হারিয়ে ফেলে। যেমন অন্ধকারে কাকতাড়ুয়া দেখেও আপনি ভূত ভেবে ভয় পেতে পারেন। কিন্তু একবার টর্চের আলো ফেলুন। ব্যস! সব শেষ। আপনি বুঝতে পারবেন আপনার ভয়ের উৎস সামান্য খড়কুটো, বাঁশ আর একটা মাটির পাত্র ও একটা জামা মাত্র।

(২) ভয়কে উপহাস করা : ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া বা ভয়কে কাবু করার আরেকটা পথ হচ্ছে ভয়কে নিয়ে ঠাট্টা করা। ভয়কে জয় করার জন্যে অবজ্ঞা ও অবহেলার চেয়ে সফল হাতিয়ার আর কী হতে পারে। আপনি ক্ষমতা না দিলে আপনার ওপর ভয়ের কোনো ক্ষমতা থাকতে পারে না। ভয় সম্পর্কে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, কেউই ভয় থেকে মুক্ত নন। ভয় পান নি পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই। তবে যারা সফল, যারা বীর তারা ভয়কে মোকাবেলা করেছেন, ভয়কে নিয়ে উপহাস করেছেন, ভয়কে অতিক্রম করেছেন। তারা কখনো ভয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি।

আমাদের অধিকাংশের জীবনে ভয় হচ্ছে ভবিষ্যতের কাল্পনিক বিপদ নিয়ে। ভবিষ্যতে কী বিপদ হতে পারে, কী ঝামেলা হতে পারে ইত্যাদি। ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা নিয়ে আপনি আপনার বর্তমানের সুন্দর সময়গুলোকে নষ্ট করছেন। আপনি আগামীকালকে যত বেশি ভয় পাবেন, ততই আপনি আজকের দিনটিকে কাজে লাগাতে ও উপভোগ করতে ব্যর্থ হবেন। বর্তমানকে পুরোপুরি কাজে লাগান, বর্তমান নিয়ে আপনি ব্যস্ত থাকুন, ভবিষ্যৎ নিজেই নিজের যত্ন নেবে। জীবনকে, জীবনের গতিকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বর্তমানকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগান, উপভোগ করুন। কারণ আপনার জীবনে বর্তমান আর দ্বিতীয়বার ফিরে আসবে না।

(৩) সাহসের ভান করা : ভয় জয় করার আরেকটি বড় কৌশল হচ্ছে ভান করা। ভান করুন, এমনভাবে অভিনয় করুন যেন আপনার জীবনে ভয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট অকপটে স্বীকার করেছেন-‘আমার জীবনে বহু কিছু ছিল যা নিয়ে আমি প্রথমে ভয় পেতাম। কিন্তু সে কাজগুলো করতে গিয়ে আমি সবসময়ই ভান করতাম যে, আমি আদৌ ভীত নই। ভান করতে করতেই আমার ভয় কমে যেতে লাগল। আমার এখন কোনো কিছু নিয়েই ভয় নেই। ইচ্ছে করলে বেশিরভাগ মানুষের জীবনেই এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে’। তাই ভয়কে জয় করার জন্যে আপনিও জোর করে ভান করুন যে, আপনি ভয় পান নি। আপনি বোঝার আগেই দেখবেন যে, ভানটাই সত্যে পরিণত হয়েছে।

আপনার জীবনেও অনেক পরিস্থিতি আসবে, যার মুখোমুখি হতে আপনি ভয় পান। হয়তো আপনি ইন্টারভিউ বোর্ডকে ভয় পান, নতুন লোকের সাথে আলাপ করতে ভয় পান, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলার ভয়, পরীক্ষার ভয়, দাঁতের ডাক্তারের কাছে যেতে ভয় পান, ইনজেকশন নিতে ভয় পান, বিমানে চড়তে ভয় পান। ঠিক আছে। আপনার এ ভয় নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আপনি শুধু একে মোকাবেলা করুন। ভয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। যে কাজকে ভয় পাচ্ছেন, সাহস করে সে কাজটা করে ফেলুন। বিশ্বাস করুন আপনি সরাসরি ভয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ভয় পালাবার পথ পাবে না। আবার এমনও হতে পারে আপনি যে কাজকে ভয় পাচ্ছেন সাহস করে করার পর সে কাজেই অপার আনন্দ লাভ করতে পারেন। যেমন আপনি বিমান ভ্রমণে ভয় পান। বিমানে কোনোদিন ওঠেন নি। সাহস করে উঠে পড়ুন বিমানে। যখন নিচের দিকে তাকাবেন, পৃথিবীকে যখন আকাশ থেকে দেখবেন তখনকার নতুন দৃষ্টি আপনাকে, আপনার উপলব্ধির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে। দাঁতের ডাক্তারের কাছে সাহস করে প্রথমেই চলে যান। হয়তো তিনি আপনার দাঁতকে ফেলে না দিয়ে রেখে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। সাহস করে ইন্টারভিউ বোর্ডের সম্মুখীন হোন। আপনার চাকরি বা পদোন্নতির দরজা খোলার এটাই তো পথ।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার একটি প্রোগ্রামে বলেছিলেন যে, তিনি একসময় এসব ভয় পেতেন। কিন্তু এখন আর ভয় পান না। কেন? কারণ তিনি তার এই ভয়গুলোকে মোকাবেলা করেছেন। ভয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। যে কাজকে ভয় পেয়েছেন, সাহস করে সে কাজটা করে ফেলেছেন। ধরুন প্লেনে চড়তে ভয় পেয়েছেন। তার মনে হয়েছে প্লেন সম্পর্কে আমার ধারণা নেই বলেই ভয় পাচ্ছি। তিনি এই বিষয় নিয়ে পড়েছেন, জেনেছেন। তারপর প্লেনে চড়েছেন। (৪) আর সেইসাথে নিয়মিত মেডিটেশন ও অটোসাজেশন চর্চা করুন। ভয় ও নেতিবাচকতা মুক্তির জন্যে ক্যাসেট বা সিডি নম্বর ২-এ বিশেষ মেডিটেশন রয়েছে। এ মেডিটেশনটি আপনার ইতিবাচক শক্তিকে জাগিয়ে দেবে এবং মনের গভীরে ইতিবাচক চিন্তাকে প্রোথিত করে দেবে। কারণ ধ্যানের স্তরে আমাদের শক্তি ও সম্ভাবনাগুলোকে আমরা একটি একটি করে বুঝতে পারি। ধ্যানের স্তরে বা সাধারণ জাগ্রত অবস্থায় অটোসাজেশনও চর্চা করুন। বলুন, অমূলক ভয়-ভীতি, নেতিবাচক চিন্তা বা নেতিবাচক কথার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া থেকে আমি পুরোপুরি মুক্ত থাকব। নিয়মিত এ অটোসাজেশনটি দিন। এছাড়া কণিকা থেকে বা বই থেকে আপনার জন্যে বেশি প্রয়োজনীয় অটোসাজেশনগুলো বেছে নিন এবং নিয়মিত এগুলো চর্চা করুন।

শিক্ষার্থী পেশাজীবী ব্যবসায়ী গৃহিণী বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ কোর্সে অংশ নিয়ে নিজের ভেতরের ভয়কে শনাক্ত করেছেন। ভয় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করেছেন। যে শিক্ষার্থীর গণিতে ভীতি ছিল, তিনি কোর্স করার দুমাসের মাথায় এসএসসি পরীক্ষায় সাধারণ গণিতে পেয়েছেন ৯৭ আর উচ্চতর গণিতে পেয়েছেন ৯৮। যে মেয়েটি সামান্য পোকা দেখলেই চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলতেন, সে মেয়েই কোর্স করার পরে বলছেন যে, প্রাণিবিদ্যা নিয়ে পড়বেন। পা কাঁপত যার ইন্টারভিউয়ের কথা শুনলে, তিনি কয়েক সপ্তাহ সাদাকায়নে অংশ নিয়েই মনছবি করলেন এবং ইন্টারভিউ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত চাকরি লাভ করলেন। এগুলো এখন বাস্তবতা। লাখো মানুষ ধ্যানের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শুধু ভয় নয়, আত্মজয় করছেন। অর্থাৎ নিজেকে আবিষ্কার করছেন, নিজের শক্তিকে খুঁজে পাচ্ছেন। গভীর প্রত্যয়ে বলতে পারছেন, আমি বিশ্বাসী! আমি সাহসী!!

উপসংহার : আজকের আলোচনায় আমরা বেশ কয়েকবার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের ভয় নিয়ে বেশ কিছু কথা উল্লেখ করেছি। স্যারের ‘ভাঙো দুর্দশার চক্র‘ বইটি আমরা আমাদের সংগ্রহে রাখতে পারি। আমাদের দুর্দশার চক্রগুলো ভাঙার অনুপ্রেরণা হতে পারে এ বইটি। এ বইয়ের বেশ কয়েকটি আলোচনায় স্যার ভয়কে কীভাবে জয় করতে হয় তা তার নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করেছেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একটি ঘটনা বলেই আজকের আলোচনার সমাপনী টানছি। একবার স্যার দলবল নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে নায়াগ্রা ফলস দেখতে যাচ্ছেন। যে দোকান থেকে গাড়ি ভাড়া নেয়া হচ্ছিল, সেই দোকানের ম্যানেজারকে তাদের একজন সঙ্গী জিজ্ঞেস করলেন যে, রাস্তা খারাপ হবে না তো? আর এই প্রশ্ন শুনে ম্যানেজার ভদ্রলোক একটা আশ্চর্য কথা বললেন। বললেন, ‘কখনোই ভাববে না খারাপ কিছু হবে। সবসময় ভাববে ভালো হবে। খারাপ খারাপ করতে থাকলে সবকিছুই খারাপ হয়ে যায়। মন ভয়ের চিন্তায় ভরে যায়। এতে মানুষ বিমর্ষ হয়ে পড়ে। এই উত্তর শুনে স্যারের মনে হলো, তাই তো! আমরা তো যাচ্ছি আনন্দ করতে। পথে নেমে এভাবে খারাপ খারাপ করছি কেন? সবসময় ভাবতে হবে ভালো হবে- ভালো কিছু হবে। এ ভাবতে পারলেই আমরা যাত্রাটাকে সত্যিকার উপভোগ করব। স্যারের বইয়েরই একটি অংশ, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার একটি লাইন উদ্ধৃত করেছেন-‘ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার’। এই লাইনটি বলার পর স্যার বলেছেন, ভীরু কিছুই পায় না জগতে। না চাকরি, না জয়, না গৌরব। এ পায় সাহসীরা। আসুন আমরা তাই সাহসী হই। পরম করুণাময় আমাদের সাহসী এবং জীবনের সবক্ষেত্রে ইতিবাচক হওয়ার তৌফিক দান করুন। এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আলোচনা শোনার জন্যে আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। সবাই ভালো থাকুন। খোদা হাফেজ।




This blog is collected
2 views0 comments

Comments


bottom of page